লেট ক্যাপিটালিজম ও পোস্ট-মডার্নিজমের এই যুগে মানুষ বা ইতিহাসের ভবিষ্যৎ-বিষয়ক চিন্তাকে ঘিরে আছে নানা ধরনের তাত্ত্বিক ও মতাদর্শিক পর্দা। সত্য, ইতিহাস, মানবতা বা কাঠামোর অনন্ত ফানার তাত্ত্বিক সুসমাচারের মধ্যেই বা বলা ভালো, সেসব সুসমাচারকে উপজীব্য করেই দেশে দেশে গড়ে উঠছে ভয়াবহরকম স্বৈরতান্ত্রিক ও নজরদারি পুঁজিভিত্তিক ভূতুড়ে রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামো। ইতিহাসের ভবিষ্যৎ কি কেবলই অনন্ত শূন্যতার বেকসুর উদ্যাপন নাকি তার বাইরেও মানুষের কোনো নয়া সম্ভাবনা বিদ্যমান? আজকের দুনিয়ায় তত্ত্ব ও মতাদর্শের সত্তর পরত পর্দা ভেদ করে এই প্রশ্ন তোলা হিম্মতের ব্যাপারই বটে। কাশফ-এ সেই হিম্মতেই আগুয়ান পারভেজ আলম।
ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, সুফিতত্ত্ব ও পপ কালচার পারভেজ আলমের চিন্তার অবলম্বন বা বীজ। নিও-মার্ক্সিস্ট তত্ত্বচিন্তা ও মেথডোলজিকে কাজে লাগিয়ে তিনি এগুলোর পারস্পরিক সংযোগ ও সংলাপের জমিন প্রস্তুত করেন অনায়াসে। সেই জমিনে নির্দ্বিধায় ছিটিয়ে দেন নিজভূমির উর্বর ভাবসম্পদের মর্মবীজও। তবে এগুলা পারভেজের টুলমাত্র। তার পরম লক্ষ্য হইল, লেট ক্যাপিটালিস্ট দুনিয়ার আইনি-রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক পর্দাগুলো ফানা করে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো চকিত, কিন্তু সুস্পষ্ট সেই সত্যকে হাজির করা, যা মানুষের মাহদীয় সম্ভাবনা ও কর্তাসত্তার নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সহায়ক।
কাশফ অর্থ উন্মোচন। তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিকভাবে শব্দটির এই অর্থের ওপরই জোর দিয়েছেন পারভেজ আলম। কিন্তু কোরানে ‘কাশফ’ শব্দটি অমঙ্গল বা আজাবকে দূরীকরণ অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। সে অর্থে কাশফ শুধু নিউ লিবারাল দুনিয়ার পর্দা উন্মোচন করে এর ভৌতিক বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েই দেয় না; বরং এই ভৌতিক বাস্তবতা বা আজাবকে দূর করার নতুন লড়াইয়ে উসকানিও দেয় বটে। পারভেজ আলমের ‘কাশফ’ এদিক থেকেও অর্থবহ, বলাই বাহুল্য।
আমাদের এ-কাল অনন্ত শূন্যতার বয়ানের মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রত্যুৎপাদন করে চলছে লেট ক্যাপিটালিজম ও নজরদারি পুঁজিশাসিত সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রকাঠামোর টিকে থাকার শর্ত। পারভেজ এই শূন্যতাকে ভয় পান না, অবজ্ঞা বা বিদ্রুপও করেন না। তিনি বরং এই শূন্যতার মোকাম থেকেই শুরু করতে চান তার যাত্রা। তবে এই যাত্রার লক্ষ্য হলো সর্বগ্রাসী এই শূন্যতার অন্তঃসারশূন্যতা ঘোষণা করা। শূন্যের ওপর পোস্তা করেই পারভেজ আলম শোনাতে চান সেই ঘর বা মদিনা গড়ে তোলার সুসমাচার, যা ‘অনাগত, কিন্তু খুবই নিকটে।’ অনাগত ভবিষ্যৎ আমাদের কতটা নিকটে, অনন্ত ক্রাইসিসের পর্দা খসে গেলে বিদ্যুচ্চমকের মতো কী নিদারুণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে নয়া মানুষের সম্ভাবনার জগৎ, জুলাইয়ে বাংলাদেশের মানুষ তা প্রত্যক্ষ করছে। কাশফ-এ পারভেজ আলম শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে সেই নতুন সম্ভাবনার অদূর দিগন্তকেই দেখতে ও দেখাইতে চান। ধন্য ধন্য বলি তারে।